‘ইতালির স্বপ্ন দেখাইয়া দুই বিঘা জমি লেইখা নিছে দালাল মনির’

জেলা প্রতিনিধি, মাদারীপুর: ‘দুই বিঘা ভুই (জমি) লেইখা (লিখে) নিয়া গেছে মনি। দুই বিঘা ভুইয়ের দাম হবে ৬০ লাখ টাকা। আমরা এর কিছুই জানি না। হঠাৎ দুপুরে ভাত না খাইয়া আমারে বলছে মা আমি যাই। জিগাইলাম কোথায় যাস? মা লিবিয়া যাই। জিগাইলাম কেডা নেয়? বলে মনির দালাল নিতেছে। তারপরেই চলে গেছে।এরপর যোগাযোগ করার পরে দালাল মনির বলেছিল’ বড় শিপে নিবে। কিন্তু সে প্লাস্টিকের একটা বোডে নিয়া আমরা ছেলেরে মাইরা ফেলছে মনে হয়। আমি এই মনির দালালের বিচার চাই, আমার ছেলের সন্ধান চাই।’

এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন লিবিয়ায় ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ কুদ্দুস বেপারীর মা শান্তি বেগম।

ইউরোপ গেলেই রাতারাতি বনে জাবেন কোটিপতি। গড়তে পারবেন বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পদ। একমাত্র শিশু ছেলে ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল। এমনই স্বপ্ন দেখেছিলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার মজুমদার কান্দি গ্রামের আতাহার বেপারীর ছেলে কুদ্দুস বেপারী (৩৩)। কিন্তু সেই স্বপ্নই রয়ে গেল তার।

জানা যায়, দ্রুত ইতালি পৌঁছে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছ থেকে প্রায় ৬০ লাখ টাকা মূল্যের ২ বিঘা জমি লিখে নেন একই গ্রামের দালাল মনির শেখ (৫০)। লিবিয়া নিয়ে ভূমধ্যসাগরে তুলে দেন ইঞ্জিনচালিত প্লাস্টিকের বোটে। পরে বোট ফেটে নিখোঁজ হন কুদ্দুস। পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। ওই বোটে আরও ৪২ জন ছিল বলে জানা গেছে। যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল বাংলাদেশি নাগরিক।

নিখোঁজ কুদ্দুস বেপারীর স্ত্রী দিনা আক্তার বলেন, আমাদের বিয়ে হয়েছে এখনও ৩ বছর পূরণ হয় নাই। এরই মধ্যে আমাদের সংসারে একজন ছেলে সন্তানের জন্ম হয়েছে। ছেলের বয়স মাত্র ৮ মাস। কিন্তু হঠাৎ দালাল মনির প্রলোভন দেখিয়ে ৫০-৬০ লাক টাকা দামের ২ বিঘা জমি গোপনে লিখে নেয়। পরে হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমার স্বামী জানায় মনির দালালের মাধ্যমে সে লিবিয়া যাচ্ছে। ৪ মাস লিবিয়া ছিল, তখন তার সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু গত প্রায় ১২ দিন যাবৎ কথা হয় না, কোনো খোঁজও পাচ্ছি না। এদিকে দালালও পালিয়ে গেছে এবং তার ফোনও বন্ধ। একপর্যায়ে জানতে পারি গত ২৪ জানুয়ারি নাকি লিবিয়ার বেনগাজি থেকে ৪৩ জনের গেম দিয়েছে। তাতে অনেকেই মারা গেছে এবং অনেকেই নিখোঁজ। সেই থেকেই আমার স্বামীরও কোনো খোঁজ নেই। এখন আমার ছেলেকে নিয়ে আমি কিভাবে বাঁচবো। এ ঘটনায় দালালের কঠোর বিচার চাই।

নিখোঁজ কুদ্দুস বেপারীর ভাই সোবহান বেপারী বলেন, আমার ভাইকে ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ২ বিঘা জমি লিখে নিছে মনির দালাল। আমার বাবা ও আমাকে কিছুই জানায়নি। সর্বশেষ ২২ তারিখে আমার ভাই আমাদের জানিয়েছে যে, গেম দেবে। এরপর আর ভাইয়ের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। গেম দেওয়ার কথা ছিল ২৫ তারিখে। কিন্তু কবে গেম দিছে তাও আমরা জানি না। বলেছিল বড় শিপে ত্রিপলি থেকে গেম দেবে কিন্তু বেনগাজি থেকে প্লাস্টিকের বোটে গেম দিছে। আমার ভাইকে চাই এবং এই ঘটনায় দালালের কঠোর বিচার চাই।

এলাকাবাসীরা জানান, রাজৈর উপজেলার মজুমদার কান্দি গ্রামের মৃত হায়দার শেখের ছেলে দালাল মনির শেখ (৫০)। দুই বছর আগেও করতেন দর্জির কাজ। তখন একই এলাকার পার্শ্ববর্তী লিটন মাতুব্বর নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল সে। পরে ওই হত্যা মামলা সমাধানের জন্য নিহতের বড় ভাই মাসুদ মাতুব্বর এর ছেলে আকাশ মাতুব্বরকে সাগরপথে ইতালি পাঠায় মনির। এরপরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। তারপর থেকেই সে ইতালি নেয়ার দালালি শুরু করেন। আর প্রতারণা করে মাত্র দুই বছরেই বিপুল পরিমাণ জমিজমার মালিক হয়েছেন তিনি।

এ ব্যাপারে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মো. সাইফুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে ভুক্তভোগী পরিবার চাইলে মামলা করতে পারেন। আমরা তাদের সহযোগিতা করব। গত বছর ১৮টি মানবপাচার মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। মানবপাচারকারীদের গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। এছাড়া এই অবৈধভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর কেউ যেন না যায় সে বিষয়ে আমরা সচেতনতামূলক সভা করছি।

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার দূতাবাসে ফেসবুক এক পোস্টে জানায়, ‘লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে ব্রেগা উপকূল থেকে বেশ কয়েকজন অভিবাসীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয় উদ্ধারকারী কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভূমধ্যসাগরে অভিবাসন প্রত্যাশীদের একটি নৌকা ডুবে যাওয়ার পর মরদেহগুলো উপকূলে ভেসে আসে।

’দূতাবাস আরও জানায়, বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, উদ্ধার হওয়া মরদেহের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিক থাকতে পারেন। তবে বিষয়টি নিশ্চিত করতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। লিবিয়ার ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল ব্রেগা থেকে ২৩ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর মরদেহ উদ্ধার হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরে একে একে মৃত্যুদেহ শনাক্ত করছে তাদের পরিবার। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে ভূমধ্যসাগরের ব্রেগা তীরে ভেসে আসা মরদেহের মধ্যে মাদারীপুরের ১১ জনকে শনাক্ত করেছে তার পরিবার এবং নিখোঁজ রয়েছে আরও ৫ জন। এরা সবাই মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার বাসিন্দা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker