জুলাই সনদের খসড়া দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে ঐকমত্য কমিশন

দেশে চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর খসড়া পাঠানো হয়েছে। শনিবার (১৬ আগস্ট) এই খসড়া দলগুলোর কাছে প্রেরণ করা হয়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং সাম্প্রতিক সময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রণীত এই খসড়ায় মোট ৮৪টি বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং বাস্তবায়নের জন্য ৮টি অঙ্গীকারনামা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

খসড়ায় শুরুতেই বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সময়কে ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জোট ও শক্তিসমূহ সম্মিলিতভাবে সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন প্রক্রিয়া, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের লক্ষ্যে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।

সনদের অঙ্গীকারনামায় অতীত ইতিহাস তুলে ধরে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সংবিধান না থাকা সত্ত্বেও সে সময়ের কার্যাবলী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। তেমনি ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহও আইনি কাঠামো না থাকা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক কনভেনশনের ভিত্তিতে বৈধতা পেয়েছে। সেই দৃষ্টান্ত সামনে রেখে, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানকেও গণতান্ত্রিক কনভেনশনের ধারায় স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে।

এতে উল্লেখ করা হয়, উল্লিখিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, জনগণের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সাংবিধানিক কনভেনশন বজায় রেখে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীগণ এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে—

১) জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জন-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলন হিসেবে দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’র দলিল হিসাবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবো।

২) এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ; তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে, এমতাবস্থায় আমরা রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট ও সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হিসাবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণয়ন করেছি বিধায় এই সনদের সকল বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করবো এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনও আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সেই ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।

৩) এই সনদের কোনও বিধান, প্রস্তাব বা সুপারিশের ব্যাখ্যাসংক্রান্ত যে কোনো প্রশ্নরে চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের উপর ন্যস্ত থাকবে।

৪) ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা, কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।

৫) ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করবো।

৬) আমরা ঐকমত্যে স্থির হয়েছি যে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত; ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হবে।

৭) আমরা সম্মিলিতভাবে ঘোষণা করছি যে, রাষ্ট্র ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারসমূহকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনে ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।

৮) আমরা এই মর্মে একমত, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর যে সকল প্রস্তাব/সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হবে সেগুলো কোনও প্রকার কালক্ষেপণ না করেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker