রেকর্ড রেমিট্যান্স প্রবাহে রিজার্ভের পালে হাওয়া

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ১১ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৪ সালে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও কম থেকে ২০২৫ সালের জুনে ৩১ বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, দেশটি এখন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে।

এ সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এর ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থিতিশীলতা, তারল্য সংকট নিরসন ও বিভিন্ন কার্যক্রমে গতি এসেছে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, রেমিট্যান্সের রেকর্ড প্রবাহ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে কাজ করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশের মোট রিজার্ভ ২০২৫ সালের ২ জুলাই পর্যন্ত ৩১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।

তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম৬) পদ্ধতি মতে, বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ বর্তমানে ২৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

এই ঊর্ধ্বগতি এসেছে রেমিট্যান্স প্রবাহের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির ফলে। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা দেশের ইতিহাসে এক অর্থ বছরে সর্বোচ্চ প্রাপ্ত রেমিট্যান্স।

এই পরিমাণ ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তুলনায় ২৬ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি।

এটি কোভিড-১৯ মহামারির সময় ২০২০-২১ অর্থ বছরে প্রাপ্ত পূর্ববর্তী রেকর্ড ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারকে ছাড়িয়ে গেছে, যখন অনানুষ্ঠানিক হুন্ডি চ্যানেলের ওপর বিধি নিষেধ এবং প্রণোদনা বন্ড চালুর কারণে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছিল।

২০২৫ সালের মার্চ মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেকর্ড ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা দেশের ইতিহাসে একক মাসে সর্বোচ্চ।

এর ধারাবাহিকতায়, সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রতি মাসেই ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, মানি লন্ডারিং কমে যাওয়া, প্রবাসী আয়ের ভালো প্রবাহ ও রপ্তানির উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে রিজার্ভ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘প্রায় ১১ মাস আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে এবং সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেয়। ইতোমধ্যেই অর্থনীতি, প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনে সংস্কারের জন্য নানামুখী নীতি নেওয়া হয়েছে, যা জনগণের আস্থা বাড়িয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডলার বিনিময় হার দীর্ঘদিন ধরে প্রায় ১২২ টাকার আশেপাশে স্থিতিশীল রয়েছে, যা একটি ইতিবাচক দিক।’

তিনি বলেন, ‘ডলারের দামের পতনের প্রধান কারণ সরবরাহ বৃদ্ধি। গত দুই বছরের মধ্যে ডলারের সরবরাহ এখন সর্বোত্তম অবস্থায় রয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বাংলাদেশের রেমিট্যান্স হঠাৎ করে বৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।

তিনি উল্লেখ করেন যে, সরকার পুঁজি বাজারে মূল্য কারসাজি ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে আর রপ্তানি প্রায় ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা এই বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।

তিনি বলেন, ‘প্রবাসীরা বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হয়েছেন।’

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, রেমিট্যান্সের জোয়ার রিজার্ভ পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং অর্থনীতিকে বড় ধরনের স্বস্তি দিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। ব্যাংকগুলোর জন্য এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এখন সবকিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিকের দিকে যাচ্ছে।’

ড. জাহিদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে, বিপদগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচাতে এবং বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।

ড. জাহিদ হোসেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ। তিনি আরও বলেন, সরকার ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর প্রভাব থেকে ব্যাংকিং খাতকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থার দিকে যাচ্ছি। তবে বলব না যে, সংকট পুরোপুরি কেটে গেছে।

প্রিমিয়ার ব্যাংক পিএলসি’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আবদুল কাইউম চৌধুরী বলেন, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত হ্রাসের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে চাপ রয়েছে, তার মধ্যে এটি এক বিশাল অর্থনৈতিক স্বস্তি হিসেবে কাজ করছে।’

সূত্র: বাসস

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker